আকীদায়ে খতমে নবুওয়াত: মির্যা কাদিয়ানীর স্ববিরোধী বক্তব্য
বিসমিললাহির রাহমানির রাহীম
মাওলানা আবু সালমান
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর লিখিত বইপুস্তক অধ্যায়ন করলে এ বিষয়টা ভালভাবেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মির্যা কাদিয়ানী নবওয়াত দাবির পূর্বে রাসূূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে শেষ নবী হিসেবেই মেনে নিয়েছিল। তাঁর পরে কোন ধরণের নবীর আগমনকে অসম্ভব ও হারাম মনে করতো। এবং তাঁর পরে সব্ ধরণের নবুওয়াতের দাবিদারকে কাফের ও মিথ্যাবাদী মনে করতো। ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ অর্থ ‘শেষ নবী’ করতো। কিন্ত পরবর্তীতে যখন নিজেই নবুওয়াতের মিথ্যা দাবি করে বসলো, তখন সে খতমে নবুওয়াতের মুতাওয়াতির (অব্চ্ছিন্ন সুত্রে বর্ণিত) অর্থের মধ্যে অপব্যাখ্যা শুরু করলো। নবুওয়াত দাবির পূর্বে সে তার বিভিন্ন পুস্তকে এ বিষয়টা পরিষ্কার লিখেছিল যে , রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী, তার পরে নবুওয়াত এবং ওহীর দরজা বন্ধ। আমরা নিম্নে তার কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরছি।
১. তার পুস্তক ‘কিতাবুল বারিয়্যাহ’ তে লিখেছে,
اور قرآن شریف جس کا لفظ لفظ قطعی ہے اپنی آیت کریمہ"ولکن رسول اللہ وخاتم النبیین" سے بھی اس بات کی تصدیق کرتا ہے کہ فی الحقیقت ہمارے نبی صلی اللہ علیہ وسلم پر نبوت ختم ہوچکی ہے۔
“কোরআনে কারীম, যার প্রতিটি শব্দ অকাট্য এই আয়াত وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ দ্বারাও এই বিষয়কে সত্যায়ন করছে যে,বাস্তবিকপক্ষে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নবুওয়াত সমাপ্ত হয়েছে। -কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন, ১৩/২১৭-২১৮
২. শাহাদাতুল কুরআন নামক গ্রন্থে লিখেছে,
چونکہ ہمارے سید و رسول صلی اللہ علیہ وسلم خاتم الانبیاء ہیں ، اور بعد آں حضرت صلی اللہ علیہ وسلم کے کوئی نبی نہیں آسکتا، اس لئے اس شریعت میں نبی کے قائم مقام محدث رکھے گئے۔
“আর যেহেতু আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুল আম্বিয়া, আর তার পরে কোন নবী আসতে পারে না, তাই শরীয়াতে মুহাদ্দাসকেই নবীর স্থলাভিষিক্ত বানানো হয়েছে।” -শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/২২৩-২২৪
৩. ‘ইযালায়ে আওহাম’ নামক গ্রন্থে লিখেছে,
ظاہر ہے کہ اگرچہ ایک ہی دفعہ وحی کا نزول فرض کیا جائے اور صرف ایک ہی فقرہ حضرت جبرائیل علیہ السلام لاویں اور پھر چپ ہوجائیں یہ امر بھی ختم بنوت کا منافی ہے
“স্পষ্ট কথা। যদি মেনে নেওয়া হয় যে মাত্র একবারই ওহী অবতীর্ণ হবে। আর একটি মাত্র বাক্য নিয়েই জিবরাঈল আ. আগমণ করবেন, পরে চুপ হয়ে যাবেন। তাহলেও বলবো যে, এটিও খতমে নবুওয়াতের পরিপন্থী বিষয়।” -ইযালা আওহাম, রূহানী খাযায়েন- ৩/৪১১
৪. অসংখ্য হাদীস শরীফে পরিস্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পরে কোন নবী নেই। নবুওয়াতের দরজা আমার মাধ্যমে বন্ধ হয়ে গেছে। সে সকল হাদীস সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানী ‘কিতাবুল বারিয়্যাহ’ নামক গ্রন্থে লিখেছে,
آنحضرتﷺ نے بار بار فرما دیا تھا کہ میرے بعد کوئی نبی نہیں آئے گا اور حدیث لا نبی بعدی ایسی مشہور تھی کہ کسی کو اس کی صحت میں کلام نہ تھا اور قرآن شریف جس کا لفظ لفظ قطعی ہے اپنی آیہ کریمہ ’’ولکن رسول اﷲ وخاتم النبیین‘‘ سے بھی اس بات کی تصدیق کرتا تھا کہ فی الحقیقت ہمارے نبیﷺ پر نبوت ختم ہوچکی ہے
“ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার বার বলেছেন, আমার পরে কোন নবী নেই। আর لا نبی بعدی (আমার পরে কোন নবী নেই) হাদীসটি এতটাই বিশুদ্ধ ও সহীহ যে, এর সহীহ হওয়া নিয়ে কখনও কারো দ্বিমত ছিল না। আর কুরআনে কারীম- যার প্রতিটি শব্দ অকাট্য-(সূরা আহযাবের আয়াত) ولکن رسول اﷲ وخاتم النبیین দ্বারাও এ বিষয়ের সত্বায়ন করছে যে, প্রকৃতপক্ষে আমাদের নবীর উপরে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।” -কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন- ১৩/২১৭-২১৮
৫. কোন কোন মহল হতে মির্যা কাদিয়ানীর উপর আপত্তি উঠলো যে, সে নবুওয়াতের দাবি করেছে। তার উত্তর দিতে গিয়ে ‘আসমানী ফয়সালা’ নামক গ্রন্থে মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে,
اور میں نبوت کا مدعی نہیں بلکہ ایسے مدعی کو دائرہ اسلام سے خارج سمجھتا ہوں
“ আমি নবুওয়াতের দাবিদার নই। বরং এমন দাবিদারকে ইসলাম হতে বহির্ভূত মনে করি।” -আসমানী ফয়সালা, রূহানী খাযায়েন-৪/৩১৩
৬. ২ অক্টোবর, ১৮৯১ সালের একটি ইশতেহারে মির্যা লিখেছে-
میں سیدنا ومولانا حضرت محمد مصطفیﷺ ختم المرسلین کے بعد کسی دوسرے مدعی نبوت اور رسالت کو کاذب اور کافر جانتا ہوں۔ میرا یقین ہے کہ وحی رسالت حضرت آدم صفی اﷲ سے شروع ہوئی اور جناب رسول اﷲ محمد مصطفیﷺ پر ختم ہوگئی۔‘‘
“আমাদের সরদার হযরত মোহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে অন্য কোন নবুওয়াত বা রিসালাতের দাবিদারকে কাফের ও মিথ্যাবাদী মনে করি। আমার আক্বিদা হলো- রিসালাতের ওহী হযরত আদম আ. এর মাধ্যমে শুরু হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত 1/230 (পুরাতণ সংস্করণ) 1/214 (নতুন সংস্করণ)
৭. ‘ইযালায়ে আওহাম’ গ্রন্থে ولکن رسول اﷲ وخاتم النبیین আয়াতের অনুবাদ করতে গিয়ে লিখেছে,
“মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নন। কিন্ত তিনি রাসূল ও নবীদের পরিসমাপ্তিকারী।” -ইযালা আওহাম, রূহানী খাযায়েন-৩/৪৩১)
মির্যা কাদিয়ানীর উপরোল্লিখ্যিত বক্তব্য সমূহ থেকে তার যে সকল দাবি ফুটে উঠেছে তা হলো,
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী।
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে নবুওয়াত ও রিসালাতের ওহীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
- ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ এর অর্থ হলো ‘শেষ নবী’
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবিদার কাফের।
‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ এর নতুন ব্যাখ্যা:
১৯০১ সালে যখন মির্যা কাদিয়ানী নবুওয়াত দাবি করলো তখন সে ‘ খাতামুন্নাবিয়্যীন’ এর নতুন এক মনগড়া অর্থ দাঁড় করালো। তার পূর্বে কোন মনীষী বা কোনো মুফাসসির ও অন্য কেউ এ ধরণের বিকৃত অনুবাদ করেনি। লক্ষ করুন,
“কেননা, মহা প্রতাপশালী আল্লাহ আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে খাতামের অধিকারী বানাইয়াছেন। অর্থাৎ তাহাকে পরিপূর্ন আশিষের জন্য মোহর দেওয়া হয় ।যাহা আর কোন নবীকে কখনও দেওয়া হয়নি। এই কারণেই তাহার নাম ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ সাব্যস্ত করা হইয়াছে।অর্থাৎ তার পরিপূর্ণ অনুবর্তিতা নবুওয়াত দান করে। এবং তাহার আধ্যাতিœক মনোনিবেশ নবী সৃষ্টিকারী হয়। আর এই পবিত্রকরণ শক্তি অন্য কোন নবী পান নাই।” -হাকিকতুল ওহী,(বাংলা).পৃ. ৭৫ . লেখক, মির্যা কাদিয়ানী
মির্যা কাদিয়ানীর উপরোক্ত বক্তব্যের সার কথা হলো- ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ এর অর্থ হচ্ছে , ভবিষ্যতে কেউ নবী হতে চাইলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মোহরের মাধ্যমে সে নবী হতে পারবে। অতএত নবুওয়াতের দরজা এখনও খোলা আছে। (নাউযুবিল্লাহ)
প্রত্যক্ষভাবে নবুওয়াতের দাবি
মির্যার স্ব-লিখিত কিতাবাদিতে এমন উদ্বৃতি কম নয় যেখানে সে প্রত্যক্ষভাবে, স্পষ্টভাষায় নবুওয়াতের দাবি করেছে। যা দেখার পর এ বিষয়ে কোন বিবেকবান ব্যক্তির কোন ধরণের সন্দেহ থাকতে পারে না। আমরা এখানে কয়েকটি উদ্বৃতি উল্লেখ করছি,
ہمارا دعوی ہے کہ ہم نبی اور رسول ہے
“আমার দাবি হলো, আমি নবী ও রাসূল” -মালফুযাত ১০/১২৭, পুরাতণ সংস্করণ, 5/447, পাঁচ খণ্ড বিশিষ্ট নতুন সংস্করণ
২. মির্যা তার কিতাব ‘তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী’ নামক গ্রন্থে লিখেছে,
میں اس خدا کی قسم کھا کر کہتا ہوں جس کے ہاتھ میں میری جان ہے کہ اسی نے مجھے بھیجا ہے اور اسی نے میرا نام نبی رکھا ہے
“আমি ঐ খোদার কছম করে বলছি যার হাতে আমার জীবন, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম ‘নবী’ রেখেছেন।” -তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৫০৩
৩. মির্যা কাদিয়ানীর শেষ চিঠি- যা আখবারে আম পত্রিকায় তার মৃত্যুর দিন প্রকাশিত হয়েছে- সেখানে সে লিখেছে,
“আল্লাহর আদেশ মোতাবেক আমি একজন নবী। আমি এই দাবি অস্বীকার করলে আমার পাপ হবে।” (মির্যার মৃত্যুর দুইদিন আগে আখবারে আম পত্রিকায় তার এই চিঠি ছাপা হয়)। -নবুওত ও খিলাফত, প্রকাশক, আহমদিয়া মুসলিম জামাত (কাদিয়ানী সম্প্রদায়) ঢাকা বকশীবাজার, ৭৬
৪. মির্যা তার ‘দাফেউল বালা’ নামক গ্রন্থে লিখেছে,
“প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল পাঠিয়েছেন।” -দাফেউল বালা, বাংলা : ১২
5. এই গ্রন্থেই সে আরো লিখেছে.
“আল্লাহ তায়ালা কাদিয়ানকে প্লেগ এর মহামারী থেকে রক্ষা করবেন, কারণ, এটা তার রাসূলের আবাসস্থল। -দাফেউল বালা, বাংলা : ১২
৬. ‘একটি ভুল সংশোধন’ নামক পুস্তকে লিখেছে,
“সুতরাং আমি যখন আজ পর্যন্ত খোদার নিকট হতে প্রায় দেড়শত ভবিষ্যদ্বানী লাভ করে স্ব-চক্ষে পূর্ণ হতে দেখেছি। তখন আমার নবী ও রাসূল হওয়া আমি কিরূপে অস্বীকার করতে পারি। যখন খোদা তায়ালা আমাকে নবী ও রাসূল আখ্যা দিয়েছেন তখন আমি কিরূপে এটা প্রত্যাখান করতে পারি, এবং তাকে ছেড়ে অন্যকে ভয় করি।” -একটি ভুল সংশোধন : ৮ লেখক, মির্যা কাদিয়ানী
আরও লিখেছে,
৭. “ দুনিয়া মে এক নবী আয়া’ অর্থাৎ পৃথিবিতে একজন নবী এসেছেন। এ রূপে বারাহীনে আহমাদিয়ায় আরও বহু স্থানে আমাকে রাসূল বলে সম্বোধন করা হয়েছে। -একটি ভুল সংশোধন : 4
৮. প্রতিবিম্বরূপে নবী,(!!)
“ অতএব, স্মরন রাখতে হবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিবিম্ব রূপে আমি নবী হওয়া অস্বীকার করি না ” -একটি ভুল সংশোধন : 7
উপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে যে, মির্যা কাদিয়ানী নবুওয়াত দাবির পূর্বে স্পষ্ট ভাষায় খতমে নবুওয়াত আকীদার স্বীকারোক্তি দিয়েছে। পরবর্তীতে নিজে নবুওয়াত দাবি করলে সে এ আকীদার অস্বীকার করে ও এর মধ্যে অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি করে।
********
Share
Tweet Whatsapp