আকীদায়ে খতমে নবুওয়াত ও মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়াত দাবি
মাওলানা আবু সালমান
বিসমিললাহির রাহমানির রাহীম
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতীর হেদায়েতের জন্য যুগে-যুগে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূলের আগমনের এই ধারাবাহিকতা হযরত আদম আ. এর মাধ্যমে শুরু হয়। পূর্বের নবীগন প্রেরিত হতেন স্ব-স্ব- গোত্রের জন্য । তাদের নবুওতের সময় সীমাও ছিল নির্ধারিত ও একটা নির্দিষ্ট যামানা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গাতে ভিন্ন ভিন্ন নবী প্রেরিত হতেন। নবীগনের আগমনের এই ধারাবাহিকতায় আগমন করলেন হযরত ঈসা আ.। তিনি এসে তার পরে এক মহান নবীর আগমনের ভবিষ্যৎবাণী করে গেলেন। এমনকি তার নাম পর্যন্ত বলে গেলেন। কুরআনে কারীমে সূরায়ে “সাফ” এর মধ্যে এ বিষয়টা এভাবে ব্যক্ত হয়েছে,
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُبِينٌ
“এবং স্মরণ কর সেই সময়কে, যখন ঈসা ইবনে মারইয়াম বলেছিল, হে বনী ইসাঈল। আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল হয়ে এসেছি। আমার পূর্বে যে তাওরাত ( নাযিল হয়ে)-ছিল তার সমর্থনকারী রূপে এবং সেই রাসূলের সুসংবাদদাতা রূপে, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। এবং যার নাম হবে আহমাদ। অতপর সে যখন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ আসলো তখন তারা বলতে লাগলো এতো স্পষ্ট যাদু।” -সুরা সাফ :৪
হযরত ঈসা আ. এর ভবিষ্যদ্ব্যাণীর প্রতিফলন হয়ে, খতমে নবুওতের মুকুট পরিধান করে, হেদায়েতের মশাল নিয়ে ধরা-পৃষ্ঠে আগমন করলেন বিশ্ব-মানবতার মুক্তির দিশারী খাতামুন্নাবিয়্যীন (আখেরী নবী) মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তিনি বিশেষ কোন জাতী বা গোত্রের জন্য প্রেরিত হননি। প্রেরিত হননি নির্দিষ্ট ও সীমিত সময়ের জন্যও। তিনি প্রেরিত হয়েছেন বিশ্ব-মানবতার মুক্তির দিশারী হয়ে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের হেদায়েতের জন্য। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
“এবং ( হে নবী) আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের জন্য একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপেই পাঠিয়েছি। ”- সূরা সাবা: ২৮
আরও এরশাদ করেন,
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
“হে রাসূল, তাদেরকে) বল, হে মানুষ, আমি তোমাদের সকলের প্রতি সেই আল্লাহর পেরিত রাসূল যার আয়ত্বে আকাশ মন্ডল ও পৃথীবীর রাজত্ব।”- সূরা আ’রাফ: ১৫৮
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا
“কত মহান তিনি যিনি তার বান্দার প্রতি ফুরকান অবতীর্ণ করিয়াছেন যাহাতে সে বিশ^জগতের জন্য সতর্ককারী হইতে পারে।” -সূরা ফুরকান: ১
যেহেতু আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানবজাতির জন্য একমাত্র নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাই তার মাধ্যমে দ্বীন ও শরীয়তকেও পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেছেন। কোরআনের ভাষায় ,
أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করিলাম।” ( সূরা মায়িদা: ৩)
আল্লাহ তায়ালা দ্বীনে ইসলামকে কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষন করার ওয়াদা করেছেন। যাতে পৃথিবীর শেষ অবধি আগত সকল মানবজাতীর জন্য এই দ্বীন এক জীবিত ও সংরক্ষিত জীবনবিধান হিসেবে অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহর এই ফয়সালাকে কোরআনে কারীম এভাবে ব্যক্ত করেছে,
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
“আমিই কোরআন অবতীর্ণ করিয়াছি এবং অবশ্য আমিই উহার সংরক্ষক।” (সূরা হিজর: ৯)
দ্বীন ও শরীয়তের পূর্ণতা দানের এই ফয়সালা, অতপর এর সংরক্ষনের এই ওয়াদা মূলত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত ও রিসালাতেরই সংরক্ষণ ও কেয়ামত পর্যন্ত এর স্থায়ীত্বেরই ফয়সালা। পূর্বের নবী-রাসূলগণ দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের নবুওতেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। এক নবীর পর আরেক নবীর আগমন ঘটে আসছিল। তাদের নবুওতের ব্যাপারে এমনটিই ছিল খোদার ইচ্ছা । কিন্তু মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পরেও তার নবুওয়ত, রিসালাত ও শরীয়াত কেয়ামত অবধি সংরক্ষিত থাকবে। মোহাম্মাদী নবুওয়তের রোশ্মী আলো ছড়াতে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। তাই কোরআনে কারীম তাকে “খাতামুন্নাবিয়্যীন” আখ্যা দিয়ে স্পষ্টভাষায় ঘোষনা করেছে
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
“ মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নহে; বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (সূরা আহযাব: ৪০)
মুফাস্সিরগন এ বিষয়ে একমত যে, ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন‘ এর অর্থ হলো- ‘শেষ নবী’। তার পরে আর কাউকে নবুওতের আসনে অধিষ্ঠিত করা হবে না। এই আয়াতের তাফছীর করতে গিয়ে প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন,
فَهَذِهِ الْآيَةُ نَصٌّ فِي أَنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ، وَإِذَا كَانَ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ فَلَا رَسُولَ بَعْدَهُ بِطَرِيقِ الْأَوْلَى وَالْأَحْرَى
“এই আয়াত এই বিষয়ে স্পষ্ট যে,তার পরে আর কোন নবী নেই। অতএব যখন কোন নবীই নেই তখন কোন রাসূল কীভাবে থাকতে পারে? (কারণ, নবী শব্দের অর্থ-ব্যাপকতায় সব ধরণের নবী রাসূল অন্তর্ভূক্ত। ফলে নবী আগমনের ধারা বন্ধ হওয়ার অর্থ রাসূল আগমনের ধারাও বন্ধ হওয়া- সংকল -তাফসীরে ইবনে কাছীর, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৬০১, দারুল হাদীস কায়রো
এছাড়াও আরও অনেক আয়াত দ্বারা এ-বিষয়টা সুপ্রমানিত যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুতাওয়াতির (অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণীত) হাদীস দ¦ারাও বিষয়টা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত। কয়েকটি মাত্র হাদীস এখানে উল্লেখ করছি।
হাদীসের আলোকে আক্বীদায়ে খতমে নবুওত:
১ নং হাদীস:
عن أبي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: >كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ، وَإِنَّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِي، وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ<
“হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বনী ইসরাঈলদের নেতৃত্ব দিতেন স্বয়ং তাদের নবীগন। যখনই কোন নবী ইন্তিকাল করতেন আল্লাহ তায়ালা অন্য আরেকজন নবীকে তার স্থলাভিষিক্ত করে দিতেন। কিন্তু আমার পরে কোনো নবী নেই। তবে খলীফা থাকবে, তাদের সংখ্যা হবে অনেক। -বুখারী, হাদীস নং ৩৪৫০
২ নং হাদীস:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " فُضِّلْتُ عَلَى الْأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ: أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ، وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ، وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ، وَجُعِلَتْ لِيَ الْأَرْضُ طَهُورًا وَمَسْجِدًا، وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ "
“হযরত আবুু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সা. এরশাদ করেন, অন্যান্য নবীগনের উপরে আমাকে ছয়টি বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। ১. আমাকে অল্প শব্দে বিপূল তাৎপর্য বোঝাবার যোগ্যতা প্রদান করা হয়েছে। ২. শত্রæ মনে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ভীতি প্রক্ষেপণের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে । ৩. আমার জন্য হালাল করা হয়েছে গনীমতের সম্পদ। ৪. আমার জন্য সমগ্র জমীনকে করা হয়েছে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম ও নামাযের স্থান। ৫. আমাকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে সর্বময় সৃষ্টি (জাতির) নিকটে। ৬. এবং আমার আগমনের মাধ্যমেই নবীগনের ধারা শেষ ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। (মুসলিম ৫২৩, কিতাবুল মাসাজিদ)
এ বিষয়ে এত অসংখ্য হাদীস বর্নিত হয়েছে যে, মুহাদ্দিসগনের বক্তব্য অনুযায়ী তা মুতাওয়াতির এর পর্যায়ে পৌছে গেছে।
হাফেয ইবনে কাছীর রহ. বলেন,
وَبِذَلِكَ وَرَدَتِ الْأَحَادِيثُ الْمُتَوَاتِرَةُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ من حَدِيثِ جَمَاعَةٍ مِنَ الصَّحَابَةِ.
‘খতমে নবুওত’ বিষয়ে রাসূল সা. থেকে মুতাওয়াতির হাদীস বর্নিত হয়েছে, যেগুলোকে সাহাবায়ে কেরামের একটি বড় জামাত বর্ননা করেছেন”। -তাফছীরে ইবনে কাছীর. খন্ড, ৩ পৃষ্ঠা,৬০১
হাফেয ইবনে হাযাম আন্দালূসী রহ. বলেন,
قد صح عن رسول الله صلى الله عليه وسلم بنقل الكواف التي نقلت نبوته وأعلامه وكتابه أنه أخبر أنه لا نبي بعده،إلا ما جائت الأخبار الصحاح من نزول عيسى عليه السلام الذي بعث إلى بني إسرائيل وادعى اليهود قتله وصلبه، فوجب الإقرار بهذه الجملة، وصح أن وجود النبوة بعده عليه السلام لا يكون البتة.
সহীহ হাদিসে যে বড় ও ভারি এক জামাত রাসূল সা. থেকে তাঁর নবুওত, (তাঁর উপর অবতীর্ণ) কিতাব ও তাঁর মুজিযার কথা উল্লেখ করেছেন সেই বড় জামাতই এই মর্মে রাসূল সা. এর সহীহ হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সা. এর পরে আর কোন নবী প্রেরিত হবেন না। তবে সহীহ হাদীসে বনী ইসরাঈলদের প্রতি প্রেরিত নবী হযরত ঈসা আ. এর অবতরনের বিষয় এসেছে, , ইহুদীরা যাকে হত্যা ও ক্রুশবিদ্ধ করার দাবী করে থাকে তিনি অবশ্যই আসবেন। আর এ বিষয়ের স্বীকারোক্তি অত্যাবশ্বক। প্রকৃত কথা হলো, রাসূল সা. এর পরে কোনো ধরণের নবুওত অস্তিত্বে আসতে পারে না। তার পরে আর কেউ নবী হতে পারবে না। -আল ফসল ফিল মিলাল ১/৬৮, (মাকতাবায়ে খানেজী, কায়রো, মিশর)
এই দুই মনীষীদ্বয়ের বক্তব্যে এ-বিষয়টা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, রাসূল সা. এর শেষ নবী হওয়া সংক্রান্ত হাদীসগুলো মুতাওয়াতির। যার দ্বারা প্রমানিত বিষয় অকাট্য। যেখানে কোন ধরণের সন্দেহ বা ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ নেই।
আক্বীদায়ে খতমে নবুওত ও ‘নুযূলে মাসীহ’
আল্লামা ইবনে হাযমের বক্তব্যে অতিরিক্ত একটা বিষয় স্পষ্ট হলো। অনেকের মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে - আখেরী যামানায় যখন হযরত ঈসা আ. অবতরণ করবেন, এবং তার আগমনকালে তিনি নবুওতের মর্যাদা থেকে অপসারিতও হবেন না। বরং নবীই থাকবেন। তাহলে শেষ নবীতো তিনিই সাব্যস্ত হলেন। কারণ তিনি রাসূর সা. এর পরে আগমন করলেন। সেক্ষেত্রে রাসূল সা. আখেরী নবী কিভাবে হলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই আল্লামা ইবনে হাযাম রহ. স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, হযরত ঈসা আ. এর পুনরাগমনের বিষয়টাও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত। আর “খতমে নবুওত” এর অর্থ হলো, রাসূল সা. এর পরে নতুন করে আর কাউকে নবুওত দান করা হবে না। হযরত ঈসা আ. রাসূল সা. এর পূর্বের নবী। রাসূল সা. এর পূর্বেই দুনিয়াতে তার আগমন ঘটেছে এবং দুনিয়াতে রাসূল সা. এর পূর্বেই তার নবুওত লাভ হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে, আখেরী যামানায় দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে অবতরণ করাবেন। যেহেতু তিনি পূর্বেকার নবী তাই তার পূণরাগমনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর “খাতামুন্নাবিয়্যীন” হওয়ার মধ্যে কোন ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে না। ইবনে হাযাম রহ. ছাড়াও অন্যান্য মনীষীগন এই বিষয়টা স্পষ্ট করেছেন। যেমন আল্লামা যামাখশারী রহ. তার বিখ্যাত তাফছীর গ্রন্থ ‘কাশশাফ’ এ আরও সুন্দরভাবে এই বিষয়টা উপস্থাপন করেছেন। তিনি সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতের অধিনে লিখেন:
فإن قلت: كيف كان آخر الأنبياء وعيسى عليه السلام ينزل في آخر الزمان؟ قلت: معنى كونه آخر الأنبياء أنه لا ينبأ أحد بعده، وعيسى ممن نبئ قبله.
“যদি প্রশ্ন হয়: যখন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম শেষ যামানায় অবতরণ করবেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী কীভাবে হলেন?
এর উত্তর হলো, তাঁর শেষ নবী হওয়ার অর্থ হলো তাঁর পরে আর কাউকে নবুওত দান করা হবে না। আর (দুনিয়াতে) হযরত ঈসা আলাইসি সালামের নবুওত অর্জিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বে। (তাফছীরে কাশ্শাফ, ১/৫৪৪, দারুল কিতাব আল আরাবী, বৈরুত)
আল্লামা যামাখশারী রহ. ছাড়াও আরো অনেক মনীষী এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একই ধরণের উত্তর প্রদান করেছেন। যেমন:
আল্লামা মাওয়ারদী রহ. (মৃত্যু. ৪৫০ হি.) তার তাফসীরগ্রন্থ ‘আন নুকাত ওয়াল উয়ূন’ এ,
আল্লামা নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (মৃত্যু: ৬৮৫ হি.) ‘তাফসীরে বায়যাবী’তে,
আল্লামা আবুল বারাকাত আন নাছাফী (মৃত্যু: ৭১০ হি.) তাফছীরে নাছাফী’তে,
আল্লামা আবুল কাসেম মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে জাযযি কালবী আল-গারনাতী রহ. (মৃত্যু: ৭৪১ হি.) ‘আত-তাসহীল লি-উলূমিত তানযীল’এ,
আল্লামা আলাউদ্দীন আলী ইবনে মুহাম্মাদ খাযেন (মৃত্যু: ৭৪১ হি.) ‘তাফছীরে খাযেন’এ,
আল্লামা নিযামুদ্দীন হাসান ইবনে মুহাম্মাদ নিশাপুরী রহ. (মৃত্যু: ৮৫০ হি.) ‘গারাইবুল কুরআন ওয়া রাগাইবুল ফুরকান’ নামক তাফছীর গ্রন্থে। যা তাফছীরে নায়ছাবুরী নামে প্রসিদ্ধ।
আল্লামা আবু হাইয়্যান আল-উন্দুলূসী রহ. (মৃত্যু: ৭৪৫হি.) ‘আল-বাহরুল মুহীত’এ,
আল্লামা ইবরাহীম ইবনে ওমর ইবনে হাসান আল বিকাঈ রহ. (মৃত্যু: ৮৮৫হি.) ‘নাযমুদ দুরার ফি তানাসুবিল আয়াতি ওয়াস সুওয়ার’এ
আল্লামা আবুস সউদ মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ রহ. (মৃত্যু: ৯৮২ হি.) ‘তাফছীরে আবিস সউদ’ নামে বিখ্যাত ‘ইরশাদুল আকলিস সালীম’এ
আল্লামা ইবরাহীম হাক্কী ইবনে মুস্তাফা রহ. (মৃত্যু: ১১২৭ হি.) ‘তাফছীরে রূহুল বায়ান’এ
আল্লামা মাহমূদ আলূসী রহ. (মৃত্যু: ১২৭০ হি.) জগদ্বিখ্যাত তাফছীরগ্রন্থ ‘রুহুল মা‘আনী’তে
উপরের আলোচনা দ্বারা এ বিষয়টা খুব ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “খাতামুন্নাবিয়্যীন” তথা শেষ নবী। তার পরে নবুওতের দরজা বন্ধ। জিল্লি নবী, বুরুজী নবী, উম্মতী নবী বা অন্য কোন ধরনের নবীই আর আসতে পারে না। এ বিষয়ের উপরেই মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত ও ইজমা। কখনও এটা নিয়ে উম্মতের মধ্যে মতবিরোধ হয়নি।
আক্বিদায়ে খতমে নবুওত “জরুরিয়াতে দ্বীন” এর অন্তর্ভুক্ত। এর অস্বীকারকারী বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুওতের দাবিদার সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। এ বিষয়ে কারও কোন ধরনের দ্বিমত নেই।
আল্লামা ইবনে নুজাইম রহ. বলেন,
لأنه رد النصوص إذا لم يعرف أن محمدا صلى الله عليه وسلم آخر الأنبياء فليس بمسلم، لأنه من الضروريات
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আখেরী নবী মানা “জরুরিয়াতে দ্বীন” এর অন্তর্ভুক্ত।আর যে ব্যক্তি তাকে শেষ নবী মানবে না সে কাফের। -আল আশবাহু ওয়ান নাযাইর: ১/১৬১, দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন
তেমনিভাবে হাম্বলী মাযহাবের বিখ্যাত মনীষী আল্লামা ইবনে কুদামা রহ. বলেন,
ومن ادعى النبوة، أو صدق من ادعاه، فقد ارتد؛ لأن مسيلمة لما ادعى النبوة، فصدقه قومه، صاروا بذلك مرتدين، وكذلك طليحة الأسدي ومصدقوه
“যে ব্যক্তি নবুওতের দাবি করে, অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে কোন নবুওতের দাবিদারকে সত্যায়ন করে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। কারণ যখন মুসাইলামা নবুওতের দাবি করেছিল এবং তার কওম (জাতি) তার এই দাবীকে সত্যায়ন করেছিল এর মাধ্যমে তারা মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। একই বিধান নবুওতের আর এক দাবিদার তুলাইহা আছাদী ও তার অনুসারীদের। -আল-মুগনী, ইবনে কুদামা হাম্বলী, ৯/২৮, মাকতাবা কাহেরা, মিশর
মোল্লা আলী ক্বারী রহ. বলেন,
دعوى النبوة بعد نبينا صلى الله عليه وسلم كفر بالإجماع
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুওতের দাবি করা সর্বসম্মতিক্রমে কুফুরী। (শরহে ফিকহে আকবার)
সুতরাং, কোরআনে কারীম, মুতাওয়াতির হাদীস ও উম্মতে মুসলিমার ইজমার মাধ্যমে এ বিষয়টা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুন্নাবিয়্যীন অর্থাৎ শেষ নবী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে কোন ধরণের নবুওত জারী থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বলে যেতেন। উপরন্ত তিনি বলেছেন,
لوكان بعدي نبي لكان عمر
“আমার পরে কেহ যদি নবী হত, তাহলে ওমর নবী হত”। -মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১৭,৪০৫, (মুআসসাসাতুর রিসালাহ) তিরমিজী, হাদিস নং ৩৬৮৬, (দারুল গরব আল ইসলামী)
তাই তিনি তার পরে নবুওতের দাবিদারকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وإنه سيكون في أمتي ثلاثون كذابون كلهم يزعم أنه نبي وأنا خاتم النبيين لا نبي بعدي
“আমার পরে কমপক্ষে ত্রিশজন এমন মিথ্যাবাদী ও প্রতারকের আবির্ভাব হবে যাদের প্রত্যেকেই দাবি করবে যে সে আল্লাহর নবী,(জেনে নাও) আমি খাতামুন্নাবিয়্যীন। আমার পরে আর কোন নবী নেই”। -সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং -২২১৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ২২৪৪৮)
মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবি
কাদিয়ানী সম্প্রদায় বড় ধোকাবাজ জাতি। তারা সরলপ্রান মুসলমানদেরকে ধোকায় ফেলে তাদের ঈমান হরণ করছে। এরা সাধারণত মুসলমানদেরকে নিজ ধর্মমতের প্রতি দাওয়াত দেয়ার সময় মির্যার নবুওত দাবির বিষয়টা গোপন রাখে। শুধুমাত্র তার মাহদী, মাসীহ ও মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবিকেই পেশ করে থাকে। যার ফলে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে যখন ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়, এবং তাদের সামনে কাদিয়ানী মতবাদের অসারতা তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয় যে, মির্যা কাদিয়ানী নবী হওয়ার দাবি করেছে। তখন তাদের অধিকাংশ ব্যক্তিবর্গই ঝট করে এটা অস্বীকার করে এবং জোর দিয়ে বলে, “তিনি তো নবুওতের দাবি করেননি। তিনি মাহদী এবং মাসীহ হওয়ার দাবি করেছেন।” পক্ষান্তরে তাদের পুরোনো ব্যক্তিরা বলে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্যের মাধ্যমে নবুওত লাভ করে উম্মতী নবী হওয়ার দাবি করেছেন। আর উম্মতী নবী প্রকৃতপক্ষে নবী নয়। যদিও তাদের মুয়াল্লিম এবং মুরব্বীরা মির্যার নবুওত দাবির ব্যাপারে পরিপূর্ণ অবগত, এবং তারা তার মিথ্যা নবুওতের উপর ঈমানও এনেছে। পরিস্থিতির স্বাভাবিক দাবির প্রেক্ষিতে মির্যা কাদিয়ানীর স্বলিখিত গ্রন্থ থেকে তার নবুওত দাবি সংক্রান্ত কিছু উদ্ধৃতি নিম্নে তুলে ধরা হলো।
প্রত্যক্ষভাবে নবুওতের দাবি
মির্যার স্ব-লিখিত কিতাবাদিতে এমন উদ্বৃতি কম নয় যেখানে সে প্রত্যক্ষভাবে, স্পষ্টভাষায় নবুওতের দাবি করেছে। যা দেখার পর এ বিষয়ে কোন বিবেকবান ব্যক্তির কোন ধরণের সন্দেহ থাকতে পারে না। আমরা এখানে কয়েকটি উদ্বৃতি উল্লেখ করছি,
ہمارا دعوی ہے کہ ہم نبی اور رسول ہے
“আমার দাবি হলো, আমি নবী ও রাসূল” -মালফুযাত ১০/১২৭, পুরাতণ সংস্করণ, 5/447, পাঁচ খণ্ড বিশিষ্ট নতুন সংস্করণ
২. মির্যা তার কিতাব ‘তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী’ নামক গ্রন্থে লিখেছে,
میں اس خدا کی قسم کھا کر کہتا ہوں جس کے ہاتھ میں میری جان ہے کہ اسی نے مجھے بھیجا ہے اور اسی نے میرا نام نبی رکھا ہے
“আমি ঐ খোদার কছম করে বলছি যার হাতে আমার জীবন, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম ‘নবী’ রেখেছেন।” -তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৫০৩
এটা বড় হাস্যকর বিষয়। একদিকে মির্যা কাদিয়ানী আল্লাহর নামে কছম করে নবুওত দাবি করছে,অপরদিকে তার সম্প্রদায়ের অনেকে তার এহেন পরিস্কার দাবিকে অস্বীকার করছে, কেও বা এই দাবিকে গোপন করছে।
৩. মির্যা কাদিয়ানীর শেষ চিঠি- যা আখবারে আম পত্রিকায় তার মৃত্যুর দিন প্রকাশিত হয়েছে- সেখানে সে লিখেছে,
“আল্লাহর আদেশ মোতাবেক আমি একজন নবী। আমি এই দাবি অস্বীকার করলে আমার পাপ হবে।” (মির্যার মৃত্যুর দুইদিন আগে আখবারে আম পত্রিকায় তার এই চিঠি ছাপা হয়)। -নবুওত ও খিলাফত, প্রকাশক, আহমদিয়া মুসলিম জামাত (কাদিয়ানী সম্প্রদায়) ঢাকা বকশীবাজার, ৭৬
৪. মির্যা তার ‘দাফেউল বালা’ নামক গ্রন্থে লিখেছে,
“প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল পাঠিয়েছেন।” -দাফেউল বালা, বাংলা : ১২
এই গ্রন্থেই সে আরো লিখেছে.
৫. “আল্লাহ তায়ালা কাদিয়ানকে প্লেগ এর মহামারী থেকে রক্ষা করবেন, কারণ, এটা তার রাসূলের আবাসস্থল। -দাফেউল বালা, বাংলা : ১২
৬. ‘একটি ভুল সংশোধন’ নামক পুস্তকে লিখেছে,
“সুতরাং আমি যখন আজ পর্যন্ত খোদার নিকট হতে প্রায় দেড়শত ভবিষ্যদ্বানী লাভ করে স্ব-চক্ষে পূর্ণ হতে দেখেছি। তখন আমার নবী ও রাসূল হওয়া আমি কিরূপে অস্বীকার করতে পারি। যখন খোদা তায়ালা আমাকে নবী ও রাসূল আখ্যা দিয়েছেন তখন আমি কিরূপে এটা প্রত্যাখান করতে পারি, এবং তাকে ছেড়ে অন্যকে ভয় করি।” -একটি ভুল সংশোধন : ৮ লেখক, মির্যা কাদিয়ানী
আরও লিখেছে,
৭. “ দুনিয়া মে এক নবী আয়া’ অর্থাৎ পৃথিবিতে একজন নবী এসেছেন। এ রূপে বারাহীনে আহমাদিয়ায় আরও বহু স্থানে আমাকে রাসূল বলে সম্বোধন করা হয়েছে। -একটি ভুল সংশোধন : 4
৮. প্রতিবিম্বরূপে নবী,(!!)
“ অতএব, স্মরন রাখতে হবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিবিম্ব রূপে আমি নবী হওয়া অস্বীকার করি না ” -একটি ভুল সংশোধন : 7
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর উল্লেখিত বক্তব্যসমূহ দ্বারা তার নবুওত দাবির বিষয়টা একেবারেই স্পষ্ট। আর ইসলামের অকাট্য বিধান হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুওতের দাবিদার কাফের। অতএব মির্যার কাফের হওয়ার ব্যাপারে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই, এবং থাকতে পারে না।
Share
Tweet Whatsapp