নবীগণের শানে মির্যা কাদিয়ানীর অবমাননা
মাওলানা আবু সালমান
মানব জাতির হেদায়েতের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে অনেক নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। যারা মানব সমাজকে এক আল্লাহর দিকে আহবান করেছেন, তাউহীদের বাণী শুনিয়েছে। যারা ছিলেন হেদায়েতের মশাল, চরিত্র বলয়ের আধার। যাদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষের হেদায়েতের জন্য। কলুষিত হৃদয়ের সকল কলুষতা দূর করে ঈমানী নূরে নূরান্বিত করার জন্য। সমাজের যত পাপাচার অনাচার আছে তার বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য।
আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের সকল মাখলুকের মধ্যে নবীগণই সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। তারা ছিলেন সময়ের সর্বোত্তম আখলাকের অধিকারী। কেননা, তারা ছিলেন মানুষের আখলাকী মুয়াল্লিম। মানুষের চারিত্রিক কদর্য যে তারাই শুধরে দিবেন। পথভোলা মানুষকে পথ দেখাবেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আলো দান করবেন। বস্তুপূজারীদেরকে স্রষ্টামূখী হওয়ার শিক্ষা দিবেন ও এক আল্লাহর এবাদতের দিকে আহবান করবেন। এ সকল গুরুদায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের অনিবার্য দাবির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা তাদের সৃষ্টি করেছেন সকল মানবীয় গুণের পূর্নাঙ্গ প্রতিচ্ছবিরূপে। ফলে জীবনের প্রতিটি শাখায় তারা ছিলেন উম্মতের জন্য অনুপম আদর্শ, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তারা ছিলেন ‘মাসূম’ তথা নিষ্পাপ পুত-পবিত্র। তাদের ‘ইসমাত’ এর উপর ঈুমান আনা সকল মুসলিমের উপর ফরজ।
এর বিপরীতে, চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শণ করে সেই সকল নবীগণের কোনো একজনের সুমহান ব্যক্তিত্বে গান্দেগীর কালিমা লেপন করা মূলত মহান আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধাচরনেরই নামান্তর। যেন একদিকে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, নবী হলেন নিষ্পাপ। অপরদিকে কোনো নাফরমান বলে উঠলো, নবী কলঙ্কিত; পবিত্র নয়। (নাউযুবিল্লাহ) বলা বাহুল্য, এ ধরণের আচরন-উচ্চারণ অত্যন্ত গর্হিত ও চরম পর্যায়ের কুফুরী। কোনো মুমিন বান্দার পক্ষে তা অকল্পনীয়। এহেন গর্হিত দুঃসাহস একমাত্র নবী-বিদ্বেষী ও খোদাদ্রোহীর দ্বারাই সম্ভব।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রাহ. তার প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আস-সারিমুল মাসলূল’, আল্লামা কাযি ইয়াজ রাহ. তার বিখ্যাত কিতাব ‘আশশিফা’, আল্লামা তাকিউদ্দীন সুবুকী রাহ. ‘আসসাইফুস সাকীল’ ও আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ. ‘তানবীহুল উলাতি ওয়াল হুক্কাম’ গ্রন্থে এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে লিখেছেন।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ ‘আস সারিমুল মাসলুল’ এ হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। লিখেছেন,
عن ليث بن أبي سليم عن مجاهد قال: أتي عمر برجل سب النبي صلى الله عليه وسلم فقتله ثم قال عمر: "من سب الله أو سب أحدا من الأنبياء فاقتلوه" قال ليث: وحدثني مجاهد عن ابن عباس قال: "أيما مسلم سب الله أو سب أحدا من الأنبياء فقد كذب برسول الله صلى الله عليه وسلم وهي ردة يستتاب ". الصارم المسلول على شاتم الرسول
“লাইস ইবনে আবি সুলাইম মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, ওমর রা. এর সামনে এক লোককে হাজির করা হলো যে-রাসূল সা.কে গালি দিয়েছে। হযরত ওমর রা. তাকে হত্যা করেছেন। এবং বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ অথবা তার কোনো রাসূলকে গালি দেয় তাকে হত্যা করে ফেল। লাইস বলেন, মুজাহিদ রাহ. হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘যদি কোনো মুসলিম আল্লাহ বা কোনো রাসূলকে গালি দেয় তাহলে সে মূলত রাসূল সা.কেই অস্বীকার করে বসলো। এ কারণে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। তাকে তাওবা করতে বলা হবে। (নতুবা, তার উপর ইরতিদাদের শাস্তি প্রয়োগ হবে) -আস সারিমুল মাসলূল 209
নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নবুওত দাবির পাশাপাশি কুরুচিপূর্ণ ও অশালীণ ভাষায় নবীগণের শানে চরম বেয়াদবী করেছে ও তাঁদের অবমাননা করেছে। কলম যা উদ্ধৃত করতে গিয়ে থেমে যায়।
পৃথিবীতে যত নবী আগমন করেছেন তারা সবাই পূর্বের নবীর সম্মান করেছেন। সম্মানের সহিত তাঁদের স্মরণ করেছেন। তাদের পবিত্র যবান থেকে এমন কোনো শব্দ নির্গত হয়নি যা থেকে তাঁদের মর্যাদাহানির সামান্নতম উপাদান পাওয়া যায়। কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের নবী ছিলেন সকল নবীর নেতা। কিন্তু তার তেষট্টি বছরের পুরো জীবনে এমন কোনো শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি যার দ্বারা পূর্বেকার কোনো নবীর অসম্মানি হয়।
কিন্তু পাঞ্জাবের ‘মুসায়লামা’ মির্যা কাদিয়ানী একদিকে তো নবুওতের মিথ্যা দাবি করে ইসলাম থেকে খারেজ হয়ে গেছে। অপরদিকে পূর্বেকার অনেক নবীগণের শানে চরম বেয়াদবীমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের মর্যাদাহানি করেছে। কখনো বলেছে, সকল নবীকে যে পেয়ালা ও সুধা পান করানো হয়েছে আমাকে একাই সে সব পেয়ালা ও সুধা পান করানো হয়েছে! আবার কখনো তার কলম নবীগণকে জখম করে লিখেছে, “সকল নবীই আমার জামার ভেতরে লুকিয়ে আছেন”। আরও কত রঙে কত ঢঙে তাদের মানহানিমূলক বক্তব্য দিয়েছে। অথচ মির্যা কাদিয়ানী নিজেও স্বীকার করে যে, কোনো নবীর শানে বেয়াদবী বা তাদের মর্যাদাহানি স্পটত কুফুরী। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে,
“ইসলামের কোনো নবীর শানে বেয়াদবী করা ও তাদের হেয় করা কুফুরী” –চশমায়ে মারিফাত, রূহানী খাযায়েন 23/390
আরো লিখেছে,
“ঐ ব্যক্তি বড়ই খবীছ ও অভিশপ্ত যে আল্লাহ তায়ালার সম্মানিত ও পবিত্র ব্যক্তিদেরকে গালি দেয়” –মালফুযাত 10/419 পুরাতন সংস্ক্রণ,
বক্ষমান প্রবন্ধতে আমরা মির্যা কাদিয়ানীর স্বলিখিত পুস্তকাদীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ।
হযরত নূহ আ. এর শানে বেয়াদবী:
হযরত নূহ আ. ছিলেন আল্লাহ তায়ালার একজন সম্মানিত নবী। আল্লাহ তাকে হাজার বছরের কাছাকাছি হায়াত দান করেছিলেন। উম্মতের দরদে, তাদের হেদায়েতের প্রত্যাশায় সদাসর্বদা ছিলেন ব্যকুল ও উৎকন্ঠিত। তার নামে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারীমে একটি স্বতন্ত্র সূরা-ই অবতীর্ণ করেছেন। তার উম্মতের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিলো তারা ব্যতীত বাকি সবাইকে আল্লাহ আযাবস্বরূপ এক মহা প্লাবনের মাধ্যমে ডুবিয়ে মারেন। তাদের কুফুরী, খোদাদ্রোহীতা ও নূহকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপের কারণেই তাদের উপরে এ আযাব পতিত হয়েছিল।
কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী প্লাবনে ডুবে যাওয়া কাফেরদের দ্বায়ভার হযরত নূহ আ.এর উপর চাপিয়ে দিয়ে বলতে চেয়েছে, নূহ আ. এর কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে খোদায়ী নিশান ও মু‘জিযা বিদ্যমান না থাকাতেই এ সব লোকদেরকে কাফের হয়ে মরতে হয়েছে। বলেছে, আমাকে আল্লাহ তায়ালা যত নিদর্শন ও মু‘জিযা প্রদান করেছেন তা যদি নূহ আ. কে প্রদান করা হত তাহলে তাদের কাউকেই আর কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। (নাউযুবিল্লাহ) মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য হলো,
“খোদা তায়ালা আমার জন্য এত বেশী পরিমাণে নিদর্শন প্রদর্শন করিয়ে যাচ্ছেন যদি এগুলো হযরত নূহ আ. এর যামানায় প্রদর্শন করতেন তাহলে তার উম্মত (প্লাবনে) ডুবে মরতো না।” – তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী, খাযায়েন ২২/৫৭৫
পাঠকমাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, এখানে মির্যা কাদিয়ানীর এ চরম বেয়াদবীমূলক বক্তব্যের অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহ তায়ালা হযরত নূহ আ. এর চেয়ে ইংরেজদের উচ্ছিষ্টভোগী ও নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানিকে বেশী ভালোবাসতেন! যার কারণে নূহ আ.কে সামান্ন পরিমাণই মূজিযা দান করেছেন। পর্যাপ্ত পরিমাণে মুজিযা দেখতে না পেয়ে তার উম্মত বেঈমান হয়ে প্লাবনে ডুবে মারা গেছে। মির্যা কাদিয়ানীর জন্য প্রকাশিত মুজিযা হযরত নূহ আ.কে প্রদান করা হলে তার উম্মত তা দেখে ঈমান আনয়ন করে মুমিন হয়ে মৃত্যুবরণ করতো।! প্লাবনে ডুবে তাদেরকে মরতে হতো না।
এটা হযরত নূহ আ. এর শানে কত জঘন্ন বেয়াদবী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
হযরত মূসা আ. এর শানে বেয়াদবী:
হযরত মূসা আ. এর হাতে আল্লাহ অনেক মুজিযার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার লাঠির সাপ হয়ে যাওয়া, তার হাত আলোকিত হয়ে যাওয়া, বনী ইসরাঈলকে নিয়ে অলৌকিকভাবে নীলনদ পার হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। কোরআনে কারীম যার সবিস্তার আলোচনা করেছে।
মির্যা কাদিয়ানী মূসা আ. এর শানে বেয়াদবী করে বলেছে, তার নিজের ‘মুজিযা’ (?) নাকি মূসা আ. এর মুজিযার চেয়েও অধিক মর্যাদাপূর্ণ। মির্যার বক্তব্য হলো,
“(আমার) যে নিদর্শনটি অচিরেই প্রকাশিত হবে তা হযরত মূসা আ. এর নিদর্শনাবলীর চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ।” –তাতিম্মা হাকিকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন 22/519
প্রিয় পাঠক, মির্যা কাদিয়ানীর জন্য কী নিদর্শন ঘটেছিল তা বলার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে একটা কথা না বললে নয়। মির্যা কাদিয়ানীর জীবদ্দশায় যা কিছুই ঘটতো সেগুলোকে সে তার ‘মুজিযা’র থলের মধ্যে রেখে ক্যানভাস করে বেড়াতো। আমেরিকাতে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হলো, তো এটা মির্যা কাদিয়ানীর এক মুজিযা। কেউ নিহত হলো, এটাও নাকি মির্যা কাদিয়ানীর মুজিযা! এ ধরনের আরও অনেক ‘মুজিযা’ সংঘটিত হয়েছে মির্যা কাদিয়ানীর জন্য। এগুলো অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করা যাবে।
ইউসুফ আ. এর শানে অবমাননা:
হযরত ইউসুফ আ. এর মর্যাদা বুঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালা তার আলোচনা প্রসঙ্গে কোরআনে কারীমে স্বতন্ত্র একটি সূরা-ই নাযিল করেছেন ‘সূরা ইউসুফ’ নামে। সেই শিশুকাল থেকেই আল্লাহ তায়ালা তাকে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি করেছেন। ছোট বেলার একটি স্বপ্ন থেকে শুরু করে নিজ ভ্রাতাগণ কর্তৃক কুপে নিক্ষিপ্ত হওয়া, গোলাম হিসেবে বিক্রি হওয়া ইত্যাদি। নিজ ঈমান ও ইজ্জত সম্ভ্রম রক্ষার্থে তিনি কারাবরণ করেছিলেন। বলাবাহুল্য, তার এ কারাবরণ ছিল সম্মানের। নিজ দীন ঈমান হেফাজতের জন্যই তাকে কারাবন্দি হতে হয়। তার এ কারাবরণকে কেন্দ্র করে আজ পর্যন্ত কোনো নাস্তিক বেঈমান পর্যন্ত কটাক্ষ বা দোষারোপ করেনি। মির্যা কাদিয়ানী-ই প্রথম ব্যক্তি যে কিনা হযরত ইউসুফ আ. এর এ কারাবরণকে সমালোচনা ও নিন্দার উপলক্ষ্য বানিয়েছে। সে বলেছে, ইউসুফ আ. এর চেয়ে আমি উত্তম। কারণ, তাকে জেলখানায় যেতে হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ,। লক্ষ করুন,
“সুতরাং এ উম্মতের ইউসুফ অর্থাৎ এ অধম (মির্যা কাদিয়ানী) ইসরাঈলী ইউসুফ হতে উত্তম। কারণ, এ অধমকে বন্দিত্বের দোয়া করার পরেও বন্দি হতে হয়নি। কিন্তু ইউসুফ আ.কে জেলহাজত খাটতে হয়েছিল। এ উম্মতের ইউসুফকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য পচিশ বছর পূর্বে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু ইউসুফ বিন ইয়াকুব নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মানুষের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছিল।”- বারাহীনে আহমাদিয়া পঞ্চম, খাযায়েন, ২১/৯৯
মির্যা কাদিয়ানীর এ বক্তব্যে কয়েকটি দাবি করেছে,
- মির্যা কাদিয়ানী হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম হতে শ্রেষ্ঠ।
- মির্যা কাদিয়ানী বন্দী হওয়ার দোয়া করেছিল। কিন্তু তাকে বন্দী হতে হয়নি। পক্ষান্তরে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে জেলে যেতে হয়েছে।
- ইউসুফ আলাইহিস সালাম নির্দোষ ছিলেন এটা মানুষের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে। কিন্তু মির্যা কাদিয়ানীর নির্দোষিতা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা প্রমাণ করেছেন।
আমরা মির্যা কাদিয়ানীর এ বক্তব্যের কোনো পর্যালোচনা করার প্রয়োজনবোধ করছি না। পাঠক নিজেই এর ভেতরে নিহিত নবীবিদ্বেষ অনুধাবন করতে পারবেন।
আদমের ন্যায় মির্যা কাদিয়ানীর জন্য সেজদার হুকুম:
আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন আদমকে সৃষ্টি করার পরে সকল ফেরেশতাকে আদেশ দিয়েছেন যেন তারা আদমকে সেজদা করে। ইবলিস ছাড়া সবাই তাকে সেজদা করেছিল।
অপরদিকে অভিশপ্ত মির্যা কাদিয়ানী হযরত আদম আ. এর এ স্বাতন্ত্রের মধ্যেও অংশীদারিত্বের দাবি করে বলেছে, যেমনিভাবে হযরত আদমকে সেজদা করতে বলা হয়েছে আমার ব্যাপারেও এমনটি বলা হয়েছে। মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য,
“যেমনিভাবে হযরত আদম আ. জময জন্ম্গ্র্হন করেছেন আমার জন্ম্ও সেভাবে হয়েছে। যেমনিভাবে আদম আ. জুমআর দিন জন্ম্ গ্র্হন করেছেন আমিও জুমআর দিন জন্ম্ গ্র্হন করেছি। যেমনিভাবে আদম আ.কে সৃষ্টি করার সময় ফেরেশতাগণ আপত্তি তুলেছিল আমার ব্যাপারেও এ ধরণের ওহী নাযিল হয়েছে। তা হলো,
قالوا أتجعل فيها من يفسد فيها قال اني أعلم ما لا تعلمون
যেমনিভাবে আদম আ. এর জন্য সেজদার হুকুম হয়েছিল আমার ব্যাপারেও আল্লাহ তায়ালার ওহীতে এ ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যমান যে,
يخرون على الاذقان سجدا ربنا اغفر لنا انا كنا خاطئين
-যমিমা বারাহীনে আহমাদিয়া, রূহানী খাযায়েন 21/260
কাদিয়ানীদের কাছে একটি সহজ সরল প্রশ্ন। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে তো আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ফেরেশতারা সেজদা করেছে। মির্যার দাবি, তার ব্যাপারেও এ ধরনের হুকুম নাযিল হয়েছে। জানার বিষয় হলো, মির্যা কাদিয়ানীকে কি কেউ সেজদা করেছে কি না? তার মুরীদরা কি তার সেজদা করতো? এর সঠিক উত্তর আমাদের জানা নেই। হয়ত কোনো কাদিয়ানী ভাইয়ের কাছে এর উত্তর থাকবে। তবে এক সূত্রে এর অনুমাননির্ভর একটা উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার উপর ভিত্তি করে কেউ যদি মির্যা কাদিয়ানীর জন্য তার মুরীদগণের সেজদা প্রমাণিত করতে চায় তাহলে তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
মির্যা কাদিয়ানী একবার কাশফে দেখলো সে খোদা হয়ে গেছে। পরে এ ব্যাপারে তার বিশ্বাসও জন্ম নিল। মির্যা কাদিয়ানী বলেছে,
“আমি কাশফে (দিব্যদর্শনে) দেখলাম আমি খোদা হয়ে গেছি। আমার বিশ্বাস হয়ে গেল হা আমিই তিনি।” –কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন 13/103
তাছাড়া তাকে নাকি জীবিত করা ও মৃত্যুদানের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
“আমাকে জীবিত করা ও মৃত্যুদানের ক্ষমতাও প্রদান করা হয়েছে।” –খুতুবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন 16/55-56
কাশফে নিজেকে খোদা হিসেবে দেখতে পাওয়া, পরবর্তীতে আল্লাহর বিশেষ গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার দাবির কারণে কখনো যদি তার মুরীদরা তাকে খোদা ভেবে সেজদা করে থাকে তাহলে হয়ত টেনেটুনে আদম আলাইহিস সালামের সাথে একটা সাদৃশ্য রচনা করা যেতে পারে।
আরেকটা সূত্র আছে যা এ ধারনাকে আরো পোক্তা করে। মির্যা কাদিয়ানী দাবি করেছে, আল্লাহ তাকে ‘বাইতুল্লাহ’ আখ্যায়িত করেছেন (তাযকিরা 28) এখানে এ প্রশ্নের যথেষ্ট সুযোগ আছে যে, তার কোনো মুরিদ তাদের এ ‘বাইতুল্লাহ’র সামনে সেজদা করেছে কি না। তাহলে অন্তত আদমের সাথে নিজের তুলনার আরেকটা সূত্র পাওয়া যাবে!
সকল নবীর শানে বেয়াদবী:
পৃথক পৃথক নবীগণের অবমাননার পাশাপাশি একত্রে সকল নবী-রাসূলেরও অবমাননা করেছে। নিম্নে তার কয়েকটি নমূনা তুলে ধরছি।
মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত নবীর আগমন ঘটেছে, তাদের প্রত্যেকের পৃথক পৃথক সকল বৈশিষ্ট ও গুণাবলীর সবই আল্লাহ তায়ালা মির্যা কাদিয়ানীকে দান করেছেন। তাই মির্যা কাদিয়ানীর ব্যক্তিসত্ত্বায় সকল নবীর প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন ঘটেছে। মির্যার বক্তব্য,
“আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, পৃথিবীতে সত্য, পবিত্র ও সম্মানিত যত নবী আগমন করেছেন একই ব্যক্তির অস্তিত্বে তাদের সকলের নমুনা প্রকাশ করবেন। আমিই সেই ব্যক্তি।” -বারাহীনে আহমাদিয়া পঞ্চম, খাযায়েন ২১/১১৭-১১৮
মির্যা কাদিয়ানীর উপরিউক্ত বক্তব্যের ফলাফল হলো, কেউ যদি হযরত ইবরাহীম আ.কে দেখতে চায় সে যেন মির্যা কাদিয়ানীকে দেখে নেয়। তেমনিভাবে অন্যান্য সকল নবীকে দেখতে চাইলে মির্যা কাদিয়ানীকে দেখে নিতে হবে। কারণ, সে সকল নবীর নমুনা। নাউযুবিল্লাহ।
সকল নবীর প্রতিচ্ছবি:
পূর্বে আলোচিত বিষয়টাকে মির্যা কাদিয়ানী আরও স্পষ্টভবে লিখেছে। তার দাবী অনুযায়ী যেহেতু আল্লাহ তাকে সকল নবীর সকল বৈশিষ্ট দান করেছেন তাই সকল নবীর নামও তাকে প্রদান করা হয়েছে।
মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে,
“আল্লাহ তায়ালা আমাকে সকল নবীর প্রতিচ্ছবি আখ্যা দিয়েছেন। সকল নবীর নাম আমার দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। অতএব, আমি আদম, আমি শীছ, আমি নূহ, আমি ইবরাহীম, আমি ইসহাক, আমি ইসমাঈল, আামি ইয়াকুব, আমি ইউসুফ, আমি মূসা, আমি দাউদ, আমি ঈসা আর আমি রাসূল সা. এর পবিত্র নামের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ জিল্লিভাবে আমি মুহাম্মাদ ও আহমাদ।” -হাকীকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৭৬, বাংলা হাকিকতুল ওহী 62 (টিকা)
এ বিষয়টাকেই মির্যা কাদিয়ানী এ পুস্তকেরই পরিশিষ্টে আরেকটু খুলে আলোচনা করেছে। বলেছে,
“আল্লাহ তায়ালার খাতায় আমার নাম শুধু ঈসা-ই নয়, বরং আমার আরও নাম রয়েছে। আমি আদম আমি নূহ, আমি ইবরাহীম, আমি ইসহাক, আমি ইয়াকুব আমি ইসমাঈল, আমি মূসা, আমি দাউদ, আমি ঈসা ইবনে মারইয়াম এবং আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অর্থাৎ বুরুজীভাবে। (নাউযুবিল্লাহ)... অতএব, সকল নবীর মান ও মর্যাদা আমার অস্তিত্বে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। -তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৫২১
আরও লিখেছে,
“সকল নবীর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন যে গুণাবলী ও যোগ্যতা বিদ্যমান ছিল সে সব গুণাবলী ও যোগ্যতা আরও বেশী মাত্রায় রাসূল সা. এর ব্যক্তিস্বত্ত্বায় বিদ্যমান ছিল। এখন সে সব গুণাবলী ও বৈশিষ্ট রাসূর সা. এর পবিত্র স্বত্ত্বা থেকে জিল্লিভাবে আমাকে প্রদান করা হয়েছে। এই জন্য আমার নাম আদম, ইবরাহীম, মূসা, নূহ, দাউদ, ইউসুফ, সোলাইমান, ইয়াহইয়াহ, ঈসা ইত্যাদি। পূর্বের নবীগণ রাসূল সা. এর কোনো কোনো গুণাবলীর প্রতিচ্ছবি ছিলেন। এখন আমি তাদের সকল গুণাবলীর প্রতিচ্ছবি।” –মালফুযাত 2/201 নতুন সংস্করণ, ৩/২৭০ (পুরাতন সংস্করণ)
একই বিষয় কবিতার মাধ্যমে মির্যা কাদিয়ানী ব্যক্ত করেছে এভাবে,
انبیاء گرچہ بودند بسے*من بعرفاں نہ کمترم زکسے
آنچہ دادست ہر نبی راجام* دادآں جام رامرا بتمام
(نزول مسیح ص۹۹، خزائن ج۱۸ ص۴۷۷)
“যদিও পৃথিবীতে অনেক নবীর আগমণ ঘটেছে, কিন্ত আল্লাহ তায়ালার মা‘রেফাতের দিক থেকে আমি কারো চেয়ে পিছিয়ে নই। বরং সকল নবীকে ভিন্ন ভিন্নভাবে যে সুধা পান করানো হয়েছে আমার একাকেই সে সুধা পান করানো হয়েছে।” -নুযূলুল মাসীহ, খাযায়েন ১৮/৪৭৭
মির্যা কাদিয়ানীর দাবি পরিষ্কার। সকল নবীকে যে গুণাবলী পৃথক পৃথক প্র্দান করা হয়েছে মির্যা কাদিয়ানী একাই সে সব গুণাবলী ও মর্যাদার অধিকারী বনে যাওয়ার স্প্ষ্ট্ দাবি। সকল নবীর গুণাবলী ও মর্যাদা লাভ করার কারণেই নাকি আল্লাহ তাকে সকল নবীর নামও প্র্দান করেছেন।
সকল নবী মির্যা কাদিয়ানীর পকেটে:
যেহেতু মির্যা কাদিয়ানীর দাবী অনুযায়ী আল্লাহ তাকে সকল নবীর গুণাবলী, বৈশিষ্ট ও মর্যাদা দান করেছেন। ফলে তাদের সকলের নামও মির্যা কাদিয়ানীকে প্রদান করা হয়েছে। এর অনিবার্য দাবি হলো, পূর্বের কোনো নবীর গুণবৈশিষ্ট জানতে হলে মির্যা কাদিয়ানীর ব্যক্তিস্বত্ত্বা সামনে আনতে হবে। মির্যা কাদিয়ানী বলেছে,
“আমার আগমনে সকল নবী পূনরায় জীবিত হয়ে গেছেন। প্রত্যেক নবীই আমার জামার ভেতরে লুকায়িত আছেন।” -নুযুলুল মাসীহ, খাযায়েন ১৮/৪৭৮
মির্যাপুত্র বশীর আহমাদ এম.এ তার বাবার সুরে সুর মিলিয়ে বলেছে,
“তার (মির্যা কাদিয়ানীর) আগমনে যেন সকল নবীরই সৃষ্টি হয়েছে।” -কালিমাতুল ফছল ২৭
হাজার নবীর নবুওত:
মির্যা কাদিয়ানীর আরেকটা দাবি হলো, আল্লাহ তাকে এত বেশী পরিমাণে মুজিযা ও নিদর্শনাবলী দান করেছেন যা হাজারো নবীর নবুওত প্রমাণে যথেষ্ট ছিল। মির্যার ভাষায়,
“আমি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই প্রেরিত - বিষয়টা প্রমান করার জন্য আল্লাহ এত বেশী পরিমাণে নিদর্শনাবলীর প্রকাশ ঘটিয়েছেন যে, যদি তা হাজার নবীর মাঝে বন্টন করে দেয়া হয় তাহলে সেগুলোর কারণে তাদের নবুওতও প্রমাণিত হয়ে যাবে।” -চশমায়ে মারিফাত, খাযায়েন ২৩/৩৩২
অন্য জায়গায় লিখেছে,
“তিনি আমার দাবি প্রমাণ করার জন্য এত বেশী পরিমাণে মুজিযা দেখিয়েছেন যে, কম নবীই এমন আছেন যিনি এত বেশী পরিমাণে মুজিযা দেখিয়েছেন।” -তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী, খাযায়েন ২২/৫৭৪
সবার সেরা:
পূর্বের আলোচনা থেকে খুব স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেল যে, মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে সকল নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করেছে। সবার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট অর্জনের দাবি করেছে। এবার জোরগলায় ঘোষনা দিল,
’’اعطانی مالم یعط احدمن العلمین‘‘ مجھے وہ چیز دی جو دنیامیں کسی دوسری انسان کو نہ دی گئی
“আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন জিনিস দান করেছেন যা বিশ্বজগতের আর কাউকেই দান করা হয়নি।” -আনজামে আথম, খাযায়েন ১১/৭৭
আরও বলেছে,
“আমার পদ-মর্যাদা এত উঁচু মিনারে অবস্থিত যার উপর আর কোনো উচ্চতা নেই।” - খুতুবাতে ইলহামিয়া, খাযায়েন ১৬/৭০
সাধারণভাবে মির্যা কাদিয়ানীর কাফের হওয়ার কারণ হিসেবে মোটাদাগে তার নবুওত দাবির বিষয়টা চিহ্নিত করা হয়। নিঃসন্দেহে রাসূল সা. এর পরে নবুওত দাবিদার কাফের। আর মির্যা কাদিয়ানী নবী হবার দাবি করে মুসাইলামার কাতারে গিয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু উপরের আলোচনা এ কথা প্র্মাণ করে দিল যে, মির্যা কাদিয়ানীর কুফুরী তার নবুওত দাবির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। যদি ক্ষণিকের জন্য এ কথা মেনে নেয়া হয় যে, মির্যা কাদিয়ানী নবী হবার দাবী করেনি এরপরেও তার অনুসারীরা তাকে ইসলামের বৃত্তে আটকে রাখতে পারবে না। নবীগণের শানে তার চরম বেয়াদবী ও অবমাননা-ই তার কাফের হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। সাথে আরও কুফুরী তো আছেই।
আল্লাহ তায়ালা সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক।
Share
Tweet Whatsapp